বিনিয়োগ ও বাণজ্যি ঘাটতি কমছে না চীনরে সঙ্গে। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান বাণিজ্য ঘাটতি সাড়ে ১৩শ কোটি মার্কিন ডলার। বড় ধরনের এ ঘাটতির কারণ দেশের মোট চাহিদার ২০ শতাংশই আমদানি হচ্ছে চীন থেকে। নানা উদ্যোগ নেওয়ার পরও কমিয়ে আনা যাচ্ছে না এ ঘাটতির অঙ্ক। অন্যদিকে বিনিয়োগের দিক থেকে কঠিন সময় পার হচ্ছে। কারণ গত অর্থবছরে চীন থেকে বিনিয়োগের কোনো প্রতিশ্রুতি মেলেনি। প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায়নি নতুন ঋণের ক্ষেত্রেও। এই সময়ে ঋণ ও বিনিয়োগে শ্লথগতির কারণ হিসাবে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে শনাক্ত করা হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত দেশে চীনের বিনিয়োগ স্থিতি প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার। বিদ্যমান এ ঘাটতি বাণিজ্য ও মন্থর বিনিয়োগ পরিস্থিতি উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখতে পারে আসন্ন থার্ড বেল্ট অ্যান্ড রোড ফোরাম ফর ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন সম্মেলন। অক্টোবরে এ সম্মেলনে অংশ নিতে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে চিঠি দিয়েছে চীন সরকার। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এ চিঠি দেওয়া হয়। অর্থ মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনেশিয়েটিভ (বিআরআই) হচ্ছে একটি চৈনিক প্রকল্প। ২০১৩ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এ প্রকল্পের সূচনা করেন। প্রকল্পের উদ্দেশ্য বিশ্বের দেড়শটির বেশি দেশকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে উন্নতি সাধনের চেষ্টা করা। প্রায় ৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়ে করার পরিকল্পনা আছে। এটি বাস্তবায়ন করতে ইতঃপূর্বে আরও দুটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। থার্ড সম্মেলন হবে চীনের বেইজিংয়ে।
জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান যুগান্তরকে বলেন, বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) অধীনে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা আরও গভীর করার জন্য আমরা উন্মুখ। এর মাধ্যমে বাণিজ্য ঘাটতি ও বিনিয়োগে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে। ইতঃপূর্বে এর আওতায় দেশে বড় কয়েকটি প্রকল্পে বিনিয়োগ হয়েছে। আশা করছি আগামীতেও এ বিনিয়োগ অব্যাহত থাকবে। তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি চীনের ঢাকার রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে একটি বৈঠক হয়। সেখানেও এই কর্মসূচিতের আওতায় সৌর বিদ্যুৎ, বিদ্যুৎ চালিত যান, প্রযুক্তি ও অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
এদিকে সম্মেলন প্রসঙ্গে ১৬ আগস্ট ঢাকার চীনা দূতাবাসের ওয়েবসাইটে রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেছেন, বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের ফলে অর্থনীতি ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে সহযোগিতার স্তর ক্রমাগত উন্নত হয়েছে। এর অধীনে চীনের সহায়তায় কয়েকটি বড় অবকাঠামো প্রকল্প বাস্তবায়নের কারণে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশের জন্য নতুন সুযোগ এনে দিয়েছে।
জানা গেছে, বিআরআই’র সম্মেলন আগে আরও দুটি হলেও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এবার গুরুত্ব অনেক বেশি। অক্টোবরে এ সম্মেলনে উচ্চপর্যায়ে তিনটি ফোরাম বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। সেগুলো হচ্ছে-বিশ্ব অর্থনীতিতে উন্মুক্ত সংযোগ, প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যের জন্য সবুজ সিল্ক রোড এবং ডিজিটাল অর্থনীতি প্রবৃদ্ধির নতুন উৎস। এছাড়া ওই ফোরামের ৬টি বিষয়ে আলোচনা হবে। এরমধ্যে রয়েছে বাণিজ্য সংযোগ, মানুষ মানুষের বন্ধন, চিন্তা-বুদ্ধির বিনিময়, ক্লিন সিল্ক রোড, উপজাতীয় এবং সামুদ্রিক সহযোগিতা। অর্থমন্ত্রীকে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, এই সম্মেলনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও চীন উভয় দেশের মানুষের মধ্যে বাণিজ্য, অর্থনীতি বিনিময়, সহযোগিতার প্রচার ও শক্তিশালী বন্ধন গড়ে উঠবে।
তবে এ ধরনের সম্মেলনে যোগদানে গুরুত্ব আছে বলে মন্তব্য করেছেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি যুগান্তরকে জানান, দেশের বাণিজ্য ও বিনিয়োগের গুরুত্বপূর্ন অংশীদার চীন। আসন্ন বিআরআই সম্মেলন থেকে কি ধরনের সাহায্য ও সহযোগিতা পেতে পারে এ নিয়ে বাংলাদেশ আলোচনা করতে পারে। বিশেষ করে বাণিজ্যসংক্রান্ত ইস্যুগুলোতে আগামীতে চীনকে আরও কতটা গুরুত্বপূর্ণ করা যায় সেটিও আলোচনায় আসতে পারে। এছাড়া চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য না বাড়ার কারণ হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের অশুল্ক শর্ত। এই অশুল্ক শর্তগুলো আরও সহজ এবং চীনের বিনিয়োগ বাংলাদেশে আনা যায় সেগুলো আলোচনা হতে পারে। আর সরকারি পর্যায়ে ঋণ সহজ শর্ত পেতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করতে পারে এবং সেটি করার প্রয়োজন রয়েছে।
জানা গেছে, বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনেশিয়েটিভ কর্মসূচির আওতায় ২০১৬ সালে ঢাকা সফরে আসেন চীনের প্রেসিডেন্ট। ওই সময় এ দেশে চার হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দেন। এরমধ্যে ২৪৪৫ কোটি ডলার অবকাঠামো প্রকল্পে এবং ১৩৬০ কোটি ডলার যৌথ উদ্যোগ বিনিয়োগের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়। পাশাপাশি চীন বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
আর পড়ুন: ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি ২২০১,ডেঙ্গুতে আরও ৮ মৃত্যু
ইআরডি সূত্রমতে, বিআরআইয়ের প্রতিশ্রুতির আওতায় চীন নয়টি প্রকল্পের জন্য ৮০৮ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে। জুন পর্যন্ত ৪৪৭ কোটি ডলার ছাড় করা হয়। ইতোমধ্যে একটি প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে এবং ৮টি চলমান। ২০২৬ সালের মধ্যে সব প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ার কথা। চলমান প্রকল্পের মধ্যে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নির্মাণ কাজ শেষের পথে। ২৮ অক্টোবরে যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে। প্রকল্পটির ব্যয় ৭০ কোটি ৫৮ লাখ ডলার। ইনস্টলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উইথ ডাবল লাইন প্রকল্পের প্রায় ৯৮ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। এর খরচ ধরা হয় ৪৬ কোটি ৫৪ লাখ ডলার। এর পরেই আছে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ। জুন পর্যন্ত ৮০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। রেললাইনটির খরচ ২৬৭ কোটি ডলার। জুন পর্যন্ত ১৯৯ কোটি ডলার পাওয়া গেছে। এছাড়া ঢাকা থেকে আশুলিয়া পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ প্রকল্পের অগ্রগতি ১৫ শতাংশ হয়েছে। এর খরচ ১২০ কোটি ডলারের মধ্যে জুন পর্যন্ত ১৭ কোটি ডলার পাওয়া গেছে। শেষ হবে ২০২৬ সালের জুনে। বিআরআই কর্মসূচির আওতায় এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলেও নতুন করে কোনো বিনিয়োগ আসছে না।
ইআরডি’র তথ্যমতে, ২০০৫-২৩ সাল পর্যন্ত ১৮ বছরে দেশে ৭০০ কোটি ডলারের কিছু বেশি বিনিয়োগ করেছে চীন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে, যার পরিমাণ ৩২৭ কোটি ডলার। এছাড়া ধাতু (নির্মাণসংশ্লিষ্ট) সরবরাহ খাতে ২১৩ কোটি ডলার, পরিবহণ ও যোগাযোগ খাতে ১১০ কোটি ডলার, আর্থিক খাতে ১৬ কোটি ও অন্যান্য খাতে ৪১ কোটি ডলার বিনিয়োগ রয়েছে। সর্বশেষ গত বছরের জুনে দেশের জ্বালানি খাতে ১৭ কোটি ডলার বিনিয়োগ করে চীনা প্রতিষ্ঠান চায়না জেনারেল টেকনোলজি। এর আগে জানুয়ারিতে পরিবহণ ও জ্বালানি খাতে যথাক্রমে ২৪ কোটি ও ১২ কোটি ডলারের দুটি বিনিয়োগ এসেছিল।
বিনিয়োগের পাশাপাশি বাণিজ্য ঘাটতিও কমছে না। প্র্রতিবছর গড়ে বাংলাদেশ সঙ্গে চীনের বাণিজ্য ঘাটতি সাড়ে ১৩শ কোটি মার্কিন ডলার দাঁড়িয়েছে। অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২৩ সূত্রে, গত অর্থবছরের (২০২২-২৩) প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) চীন থেকে ১৪৩৪ কোটি ডলারের আমদানি এবং রপ্তানি হয়েছে ৭৭ কোটি মার্কিন ডলারের। অর্থবছরে (২০২১-২২) আমদানি হয় ১৯৩৫ কোটি ডলারের পণ্য। বিপরীতে রপ্তানি হয়েছে ৬৮ কোটি ডলারের পণ্য। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ চায়না চেম্বার অব কর্মাস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিআই) সাধারণ সম্পাদক আল মামুন মৃধা যুগান্তরকে জানান, বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনেসিয়েটিভে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে প্রথম স্বাক্ষরকারী হচ্ছে বাংলাদেশ। এর সুবাধে পদ্মা সেতু ও কর্ণফুলী টানেলসহ বড় প্রকল্পগুলোতে চীন বিনিয়োগ করেছে। ইতোমধ্যে অনেক প্রকল্প বাস্তবায়নও হয়েছে। কিছু চলমান আছে। বাস্তবায়িত প্রকল্পগুলো অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ফলে বিনিয়োগসহ অভ্যন্তরীণ সার্বিক উন্নয়নে পাওয়া যাচ্ছে সেটিও বিআরআইয়ের সুবাদে।
আপনার মতামত লিখুন :