নাটোরে এখনো বিক্রি হচ্ছে মিনিকেট চাল,ভোক্তার অভিযান চলছে । উত্তরের শষ্যভান্ডার খ্যাত নাটোর জেলার হাটবাজারগুলোতে “মিনিকেট” চালের নামে রমরমা প্রতারণামূলক ব্যবসা চলছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ চাল খেয়ে মরণব্যাধি ক্যান্সারসহ মানব দেহে হচ্ছে বিভিন্ন রোগ-বালাই।
নাটোরের সদর উপজেলা ,সিংড়া ,বড়াইগ্রাম ও গুরুদাসপুর উপজেলায় বেশ কয়েকজন অটোরাইস মিল ব্যবসায়ী এই “মিনিকেট” চাল বিক্রি করে শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। ওই ব্যবসায়ীরা শুধু মোটা চাল চিকন করে মিনিকেট বলেই বিক্রি করছে না। অটোরাইস মিল বসিয়ে বর্জ ফেলে এলাকার পরিবেশ দূষণ করছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। এদিকে মিনিকেট নামে চাল বিক্রি বন্ধে নাটোরে অভিযান অব্যাহত রেখেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর জেলা কার্যালয়। বৃহস্পতিবার প্রথম দিনের অভিযানে ওই জাতীয় চাল বিক্রি বন্ধ রাখতে ব্যবসায়ীদের নির্দেশ দেন তারা । সেইসঙ্গে ব্যবসায়ীদের সতর্ক করেন। কিন্তু তারপরও নাটোরের বাজারে দেদারছে বিক্রি ও মজুদ করা হচ্ছে মিনিকেট চাল ।
কৃষিবিদ মামুনুর রশীদ জানান ,’মিনিকেট’ নামে ধানের কোনো জাত নেই। সাধারণ মোটা চাল মেশিনে চিকন করা হয়। তার নাম হয় মিনিকেট। এই চালের পুষ্টিগুণ কমে যায়। চাল ব্যাবসার সাথে যারা তাদের মুখ থেকেই এসব তথ্য পেয়েছি। বিষয়টি চরম উদ্বেগের। শুধু মুনাফার লোভেই ব্যবসায়ীরা দেশের মানুষের প্রধান খাদ্যপণ্যে চালের এই হাল করবে এবং মানুষ না জেনে সেগুলোকে উৎকর্ষ ভেবে বেশি দামে কিনবে-এ ধরণের প্রতারণা মেনে নেয়া যায় না। সরকারের উচিত বিষয়টি তদন্ত করা। মানুষকে সচেতন করতে ব্যাপক প্রচারণাও দরকার। এ ধরণের অপকর্ম নিষিদ্ধ করার জন্য সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।
তিনি আরোও জানান, বাংলাদেশ কিংবা ভারতসহ বিশ্বের কোনো দেশেই মিনিকেট নামে ধানের কোনো জাত নেই। মূলত একশ্রেণীর চালকল মালিক ভোক্তাদেরকে বোকা বানিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মোটা চাল ছেঁটে সরু করে তা মিনিকেট নামে চালিয়ে যাচ্ছে।
জানা যায়, ১৯৯৫ সালের দিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত ভারতের কৃষকদের মাঝে সে দেশের ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট নতুন জাতের চিকন শতাব্দী ধানবীজ বিতরণ করে। মাঠপর্যায়ে চাষের জন্য কৃষকদেরকে এ ধানবীজের সঙ্গে আরও কিছু কৃষি উপকরণসহ একটি মিনিপ্যাকেট প্রদান করে ভারতীয় সরকার। মিনিপ্যাকেটে করে দেয়ায় ভারতীয় কৃষকদের কাছে এ ধান শেষমেষ মিনিকিট বলেই পরিচিতি লাভ করে।
নাটোরের বেশ কয়েকজন রাইস মিলের ড্রাইভার জানান, অটোরাইস মিলে রয়েছে একটি অতি বেগুনি রশ্মির ডিজিটাল সেন্সর প্ল্যান্ট। এর মধ্য দিয়ে যে কোনো ধান বা চাল পার হলে সেটি থেকে প্রথমে কালো, ময়লা ও পাথর সরিয়ে ফেলা হয়। এরপর মোটা ধান চলে যায় অটোমিলের বয়লার ইউনিটে। সেখানে পর্যায়ক্রমে ৫টি ধাপ পার হবার পর লাল কিংবা মোটা চাল সাদা রংয়ের আকার ধারণ করে। এরপর আসে পলিশিং মেশিংয়ে। অতি সুক্ষ এই মেশিনে মোটা চালের চারপাশ কেটে চালটিকে চিকন আকার দেয়া হয়। এরপর সেটি আবারও পলিশ ও স্টিম দিয়ে চকচকে শক্ত আকার দেয়া হয়। শেষে সেটি হয়ে যায় সেই কথিত এবং আকর্ষণীয় মিনিকেট চাল। আর চকচকে করার জন্য দেয়া হয় বিভিন্ন ক্যামিকেল যা মানব দেহে ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেক বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় মোটা চাল ছেঁটে চিকন করে কম দামের চাল বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে তা জনস্বাস্থ্যের জন্য চরম হুমকি বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
নাটোর আধুনিক হাসপাতালের আর এমও ডাঃ সামিউল ইসলাম শান্ত বলেন, পলিশ করার কারণে মিনিকেট চালে শর্করার পরিমাণটা আরও বেড়ে যায়। এটা বেড়ে যাওয়া মানে আমরা যখন মিনিকেট চালের ভাত খাব তখন ওই উপাদানটা গ্লুকোজে রূপান্তরিত হয়ে দ্রুত রক্তে মিশে যাচ্ছে। ফলে সেটা ডায়াবেটিস হওয়ার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অর্থাৎ এই চাল খেয়ে ডায়াবেটিস আক্রান্তের হার বাড়ছে। আর যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে তাদের ডায়াবেটিসের মাত্রা আরও বাড়ছে। এ ছাড়া ক্যানসার, অতিরিক্ত মোটা হয়ে যাওয়া- এ ধরনের রোগে আক্রান্ত হওয়া এবং কম বয়সেই বার্ধক্য চলে আসে এই চাল খেয়ে।
নাটোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশের পশ্চিমাঞ্চলের যশোর, ঝিনাইদহ, সাতক্ষীরা ও কুষ্টিয়া জেলাতে কথিত মিনিকেট ধানের চাষ হয়। মিনিকেট নামে বাংলাদেশ সরকার অনুমোদিত কোনো জাতের ধান নেই। বিআর ২৮, কল্যানী, স্বর্ণা, গুটিস্বর্ণা, লাল স্বর্ণা আইঅর-৫০, জাম্বু ও কাজল লতা জাতের ধান ছেঁটে মিনিকেট বলে বস্তায় ভরে বিক্রি করা হচ্ছে। বাজারে এ চালের ব্যাপক চাহিদার জন্য এ মিনিকেট প্রতারণার ব্যবসা চলছে।
দেশে প্রায় এক হাজার প্রকারের ধান চাষ হয়। এর মধ্যে মিনিকেট এবং নাজিরশাইল নামের কোনো ধান বাংলাদেশে চাষ হয় না। অথচ বাজারে মিনিকেট ও নাজিরশাইল চালে সয়লাব। তা হলে এই দুই নামের চাল এলো কোথা থেকে। আর মিনিকেট-নাজিরশাইল নামে যে চালটি দেশের মানুষ দেদারসে খাচ্ছে সেটি আসলে কতটা পুষ্টিগুণসম্পন্ন এবং এটি স্বাস্থ্যসম্মত কি না- এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে ।
নাটোরের চালকল মালিক রফিক মিয়া জানান, নাটোরের চালকলগুলোতে মিনিকেট বা নাজিরশাইল নামে কোন চাল উৎপাদন করা হয়না । দেশের মিনিকেট ও নাজিরশাইল নামে যে চাল বিক্রি হচ্ছে তার ৯০ ভাগ উৎপাদন হয় কুষ্টিয়া জেলায়। কুষ্টিয়ার খাজানগরে তিন শতাধিক অটো রাইস মিল রয়েছে। দুই শতাধিক ম্যানুয়াল রাইস মিল রয়েছে। এসব মিলেই তৈরি হয় মিনিকেট চাল। খাজানগর, কবুরহাট, আইলচারা, এলাকার মিলগুলোতেই লাখ লাখ মেট্রিক টন চাল উৎপাদন হয়। বিআর ২৬-এর সঙ্গে মেশানো হচ্ছে বিআর ২৮ ধান। বিআর ২৬-এর তিনগুণ বেশি উৎপাদন হয় বিআর ২৮। এই ২৬ আর ২৮-এর সঙ্গে মিশিয়ে তৈরি হচ্ছে মিনিকেট চাল। চাল চকচকে আর পলিশ করার জন্য ব্যবহার হচ্ছে ইউরিয়া সার, যা মানবশরীরের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
আরও পড়ুনঃ টুঙ্গিপাড়ায় পিতার সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানালেন প্রধানমন্ত্রী
নাটোরের চালকল মালিকরা প্রকাশ্যেই মোটা চাল মেশিনে দিয়ে চারপাশ থেকে ছেঁটে ফেলে চিকন করে মিনিকেট, নাজিরশাইল, কাজল লতা ও ব্রি-২৮ নামে বিক্রি করছেন। কমদামের মোটা চাল চিকন করে কেজিতে ২০ থেকে ২৫ টাকা করে বাড়তি দাম পাচ্ছেন মিল মালিকরা। আর চালের ছেঁটে ফেলা অংশ চালের গুঁড়ি হিসেবে বিক্রি করে পাচ্ছেন বাড়তি মুনাফা। চালকল মালিকদের এই রমরমা বাণিজ্যের উল্টো দিকে ঠকছেন ক্রেতারা। মোটা চালের ভেতরের অংশ বেশি দামে কেনা ছাড়াও চালের উপরিভাগে যে পুষ্টি থাকে, তা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন নকল চিকন চাল খাওয়া ক্রেতারা।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর জেলা কার্যালেয়র অধিদফতরের সহকারী পরিচালক মেহেদী হাসান তানভীর বলেন, নিয়মিত বাজার তদারকির অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে জেলার বাগাতিপাড়া উপজেলায় অভিযান চালানো হয়। এ সময় বেশ কয়েকটি পাইকারি দোকানে “মিনিকেট চাল” লেখা বস্তা দেখা যায়। সরকারি নির্দেশনার কথা ব্যবসায়ীদের জানিয়ে ওই জাতীয় চাল বিক্রি বন্ধ রাখতে বলা হয়। মিলে চাল বস্তায় ভরার পর তার ওপরে চালের জাতের নাম লিখতে বলা হয়েছে। মিনিকেট নামে কোনও চাল বিক্রি করা যাবে না। এর ব্যত্যয় ঘটলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে ব্যবসায়ীদের জানানো হয়েছে ।
উৎসঃ বা. প্র.
আপনার মতামত লিখুন :